এইচ আর হীরা॥ বরিশালের গ্রামীণ জনপদের বেশিরভাগ মানুষের চলাচল, পণ্য পরিবহন, জীবন-জীবিকা নদী, খাল ও বিলের ওপর নির্ভরশীল। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সড়কপথের উন্নয়ন ঘটেছে তবে নদী, খাল ও বিল বেষ্টিত এ অঞ্চলে নৌ-যানের ওপর নির্ভরশীলতা কমেনি সাধারণের।
তাই বৈঠার নৌকাসহ ইঞ্জিনচালিত বিভিন্ন নৌ-যানের চাহিদা বেড়ে চলছে এ অঞ্চলে।গত চারমাস যাবত করোনা সংক্রমণের কারণে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যে প্রভাব পড়লেও তেমনটা ঘটেনি নৌকার হাট-বাজারে। বর্ষার শুরু থেকেই এ অঞ্চলে নৌকার হাটগুলোতে স্বাভাবিক সময়ের মতোই বেচা-বিক্রি হচ্ছে।নৌকার হাটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা বলছেন,বর্ষাকালে নদী ও খাল-বিল
পানিতে টইটুম্বর থাকায় নৌকাই হয়ে ওঠে স্থানীয় যাতায়াতের প্রধান চালিকা শক্তি। ফলে প্রতিবছর বর্ষায় শুরু হওয়ার আগ থেকেই নৌকা তৈরির কারিগররা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ক্রেতাদের চাহিদামতো স্ত্রী, সন্তান নিয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করে ছোট-বড় নৌকা তৈরি করেন এর কারিগররা। যা হাট-বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহও করছেন এ অঞ্চলের অনেক পরিবার।
সেই হিসেবে সারাবছর যেমন তেমন গেলেও বর্ষায় নৌকার বাজার জমজমাট থাকছে প্রতিবছর।জানা গেছে, বিভাগের ছয় জেলায় মানুষের চলাচলসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে নৌকার ব্যবহার এখনো রয়েছে। বিশেষ করে খাল-বিল ও নদীতে মাছ শিকারে এ অঞ্চলে এখনো হাত বৈঠায় চালিত নৌকার ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। আবার বর্ষায় নিম্নাঞ্চলগুলো পানিতে নিমজ্জিত থাকায় সাধারণ মানুষকে পুরোপুরি নৌকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়।সরেজমিনে গত শুক্রবার আটঘর-কুড়িয়ানার হাটে গিয়ে দেখা যায়,
খালে ও রাস্তার দু‘ধারে কেবল নৌকা আর বৈঠা। মেহগনি, চাম্বল, কড়াই ও রেইনট্রি গাছ দিয়ে নির্মিত এসব নৌকা দেখতে স্থানীয় ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ী আর উৎসুক মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মতো। যে দিকে চোখ পড়ে সেদিকেই দেখা যায় সারিবদ্ধ বিভিন্ন আকারের নৌকা আর নৌকা।এদিকে এসব নৌকার কাঠ ও আকার ভেদে রয়েছে দামের ভিন্নতা। চাম্বল কাঠ দিয়ে তৈরি একটি আটহাত দীর্ঘ
নৌকা বিক্রি হয় ১৮শ থেকে ২২শ টাকায়। এছাড়া ৯, ১০ ও ১২ হাত সাইজ পর্যন্ত বাহারি ডিজাইনের নৌকাও আসে এখানে।আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান চাষি লিটন হাওলাদার জানান, বর্ষাকালে বাগান পরিচর্যা করতে ছোট ছোট খাল পেরিয়ে বাগানে যেতে নৌকার প্রয়োজন হয়। তাই এবছরও বর্ষার শুরুতে পছন্দমতো নৌকা কিনেছি। আর ডিঙি নৌকার সুবিধা হচ্ছে এগুলো খুব হালকা এবং সরু, তাই সহজেই যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যায় এ নৌকা তেমনি দ্রুত চালনা করা যায়।
তিনি আরো বলেন কৃষি কাজ পরিচর্যা, পেয়ারা বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ ও বিক্রি, বিল থেকে শাপলা তোলা, মাছ শিকার করাসহ নানান প্রয়োজনে নৌকা আমাদের কর্মজীবনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। যুগ যুগ ধরে নৌকা এখানকার দীর্ঘ সময়ের ঐতিহ্য বহন করে আসছে।
এ যেন চিরচেনা বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের কথা জানান দেয়।যদিও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্ষার কারণে ফসলি জমি কিংবা বসতবাড়ি নির্মাণ কাজ কমে যাওয়ায় অলস হয়ে পড়েন কাঠমিস্ত্রিরা। তাদের এই অলস সময়ে নৌকা তৈরিতে লেগে পড়েন তারা। গ্রাম ঘুরে অপেক্ষাকৃত কম দামের জারুল, রেইনট্রি, চাম্বল, কদম, রয়না ও আম কাঠ দিয়ে ঘরে বসেই স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে কাঠমিস্ত্রিরা তৈরি করেন বিভিন্ন সাইজের নৌকা।
তবে বিভিন্ন নৌকার মধ্যে চালনা সহজ ও ওজনে হালকা হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে তথা বরিশালের মানুষের কাছে ডিঙি নৌকার কদর একটু বেশি । আর ডিঙি নৌকার হাটগুলোর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী হচ্ছে বরিশাল জেলা সংলগ্ন পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানার হাট। এছাড়াও বরিশাল জেলার গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলার কমপক্ষে ১০টি হাটে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে ডিঙি নৌকা।আগৈলঝাড়ার বারপাইকা গ্রামের নৌকা তৈরির কারিগর নকুল ঘরামী জানান, বর্ষার মধ্যেও নৌকা তৈরি তাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা ধরে রেখেছে। যা অন্য কারিগরদের ক্ষেত্রে ঘটছে।
তিনি জানান, স্থানীয় ব্যবসায়ী ছাড়াও স্বরূপকাঠি, বানারীপাড়া, উজিরপুর ও মাদারীপুর এলাকার ব্যবসায়ীরা এসে তাদের কাছ থেকে নৌকা কিনে নিয়ে যান। যা তারা অন্য বড় বাজারগুলোতে নিয়ে বিক্রি করেন। একেকটি নৌকা প্রকারভেদে দুই থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
আটঘর-কুড়িয়ানার হাটের নৌকা পাইকার বিক্রেতা রফিক জানান, পিরোজপুরের নেছারবাদ (স্বরুপকাঠি), বরিশালের বানারীপাড়া, আগৈলঝাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এই সময়ে বাড়িতে বসে কারিগররা এসব নৌকা তৈরি করছেন।তাদের মতো পাইকাররা বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে এসব নৌকা ক্রয় করে হাটে এনে বিক্রি করছেন। কাঠ ও আকার অনুযায়ী এসব ডিঙি নৌকা বিক্রি করেন তারা।
প্রকারভেদে আড়াই হাজার থেকে পাঁচ হাজার বা এর চেয়েও বেশি টাকা দরে এসব নৌকা বিক্রি করা হয়ে থাকে। আর নৌকা চালনার জন্য হাতের বৈঠা বা দ্বার তিন থেকে পাঁচশ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। যা আলাদাই কিনতে হয় ক্রেতাকে।আটঘর-কুড়িয়ানার হাটে নৌকা কিনতে আসা রমেশ চন্দ্র ও বিশ্বজিৎ হালদার জানান, বর্ষায় গো-খাদ্য সংগ্রহসহ চলাচলের জন্য আমাদের নৌকার প্রয়োজন হয়।
দাম কিছুটা কম হওয়ায় প্রতিবছরই একটি করে ডিঙি নৌকা কিনেন। আর ডিঙি নৌকাটাও তৈরি হয় অনেকটা এক মৌসুম বা এক বর্ষার জন্য। তবে একাধিক মৌসুমে এক নৌকা ব্যবহার করতে চাইলে তার পেছনে খরচটাও বাড়াতে হয়।
Desing & Developed BY EngineerBD.Net
Leave a Reply