বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সকাল ৬:২৬

শিরোনাম :
রেমিটেন্স আহরণে রূপালী ব্যাংকের ২ দিন ব্যাপী ক্যাম্পেইন সম্পন্ন সদর উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী জসিম উদ্দিনের মনোনয়ন বৈধ ঘোষনা বরিশালের দুই উপজেলায় বৈধতা পেলেন ২৫ প্রার্থী ঝালকাঠিতে বেপরোয়া ট্রাক কেড়ে নিল ১৪ প্রাণ বরিশাল সদরে ভাইস চেয়ারম্যান পদে হাদিস মীরের মনোনয়ন দাখিল বরিশালে তীব্র গরমে নাভিশ্বাস জনজীবন,বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ! বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে জসিম উদ্দিনের মনোনয়নপত্র দাখিল বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে এসএম জাকির হোসেনের মনোনয়নপত্র দাখিল দুই উৎসবের ছুটি শেষে বরিশাল থেকে কর্মস্থলে ফিরছে মানুষ ঈদ আনন্দ থাকতেই বরিশালে বইছে পহেলা বৈশাখের আনন্দ

বরিশালে উন্নয়নের বাধা ‘সমন্বয়হীনতা’

dynamic-sidebar

সৈয়দ মেহেদী হাসান,অতিথি প্রতিবেদকঃ সর্বশেষ ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালে মেয়র শওকত হোসেন হিরনের সময়ে বড় ধরনের উন্নয়ন হয়েছে বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৫৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায়। তারপর যেন হঠাৎ করেই উন্নয়ন শব্দটির সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ বরিশাল নগরীর। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালে বিএনপির মেয়র আহসান হাবিব কামালের সময়ে যতো না উন্নয়ন হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে হরিলুট। এজন্য আহসান হাবিব কামাল ও কামালপুত্র কামরুল আহসান রুপমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) গড়িয়েছে মামলা।

আর ২০১৮ সাল থেকে বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ পরিষদের হাত ধরে দ্রুত উন্নয়নের ছোঁয়া পাবেন নগরবাসী- এমন প্রত্যাশা থাকলেও প্রায় দুই বছর পার হতে চললেও উন্নয়নের ‘সোনার হরিণ’ আজও অদৃশ্য।

উল্টো সবর্ত্রই অব্যবস্থাপনা, ৯০ শতাংশ সড়ক চলাচলের অনুপযুক্ত, ভেঙে পড়েছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, মশা নিয়ন্ত্রণে নেই পদক্ষেপ। নগরবাসী বলছেন, নগর ভবনে সেবার পরিবর্তে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে হোল্ডিং ট্যাক্স। পাশাপাশি করোনায় রোজগার বন্ধ রিকশা-ইজিবাইক চালকদের নবায়ন ফি মওকুফের বদলে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, বর্তমান পরিষদ গঠনের পর কোনো বরাদ্দই আসেনি নগর ভবনে। বরাদ্দ এলে বিগত দিনের যেকোনো উন্নয়নকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে বর্তমান পরিষদ।

শওকত হোসেন হিরন থেকে বর্তমান পরিষদ আমল পর্যন্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রধান প্রধান ক্ষেত্রগুলোর বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি। অল্পবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, যানজট, সড়কে খানা-খন্দ ছাড়াও নাগরিক সুবিধা বিবর্জিত নগরের বর্ধিতাংশে রয়ে গেছে পুরোনো চিত্রও।

যদিও শওকত হোসেন হিরন মেয়র থাকাকালে যানজট নিরসনে সড়ক প্রশস্তকরণ, ফোরলেন নির্মাণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা পুনর্নির্মাণ, বাস ও ট্রাক টার্মিনাল শহরের বাইরে স্থানান্তরের কাজে হাত দিয়েছিলেন।

তবে পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, নগর উন্নয়নে পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে কাজ বাস্তবায়ন করতে হয়। অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের চেষ্টা চালালে তা পর্যায়ক্রমে নগরবাসীর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সেটাই ঘটেছে বরিশালেও।

নগর উন্নয়নে কাজ করা সরকারি পরামর্শক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনাবিদ মো. বায়েজিদ মনে করেন, একটি নগরের চিত্র নির্ভর করে উন্নয়নের মাস্টারপ্ল্যানের ওপরে। দেশের প্রত্যেকটি নগরে পাঁচ বছর পর পর জনসংখ্যা, জাতীয় অবকাঠামোগত পরিকল্পনা এবং মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে মাস্টারপ্ল্যান হালনাগাদ করা হয়। কিন্তু বরিশালে গত দশ বছরেও মাস্টারপ্ল্যান হালনাগাদ করা হয়নি। যে কারণে দশ বছরে যা হয়েছে, তা অপরিকল্পিত উন্নয়নেরই নামান্তর। এসব নগরীর জন্য সুফল বয়ে আনেনি।

এই কর্মকর্তা বলেন, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর তিনটি ধাপে পরিকল্পনা নেয়। প্রথমত, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বা স্ট্রাকচারাল এরিয়া প্ল্যান, যার ব্যপ্তি ২০ বছর। দ্বিতীয়ত মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা বা আরবান এরিয়া প্ল্যান, যার ব্যপ্তি দশ বছর। তৃতীয়ত স্বল্পমেয়াদী বা অ্যাকশন প্ল্যান, যার ব্যপ্তি তিন থেকে পাঁচ বছর।

মো. বায়েজিদ বলেন, ‘নগরের সক্ষমতা ধরে রাখতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হয়। বরিশাল নগরের জন্য অনেকগুলো অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়িত হয়নি বলেই আজকের এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য একা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দায়ী নয়। মূলত আমরা সবাই দায়ী। কারণ, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর সুুন্দর নগর গড়ে তুলতে পরিকল্পনা করে দিতে পারে। বাস্তবায়নের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। উন্নয়ন বাস্তবায়িত হলে সেগুলো রক্ষণের দায়িত্ব নগরবাসীর। এখানেই আমাদের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।’

‘কোনো উন্নয়ন কাজ হলে তা যত্ন করে ব্যবহার করার প্রবণতা যেমন সাধারণ মানুষের মাঝে নেই, তেমনি মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নেও খুব একটা আগ্রহ লক্ষ্যণীয় নয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর।’

সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৮ অক্টোবর ‘বরিশাল নগর উন্নয়ন মাস্টারপ্ল্যান’ অনুমোদন দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ওই প্ল্যানে তিন লাখ পাঁচ হাজার ৯ জনের বসবাসের তথ্য পাওয়া যায় নগরীতে। যেখানে ভূমি ব্যবহারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইন অনুসরণ করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুপারিশ করা হয়েছিল। অর্থাৎ কৃষিজমি নষ্ট না করে স্বল্প জমি পরিকল্পনা করে বেশি মানুষের উপযোগিতা অনুসারে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ সুফল ভোগ করা এবং উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইন মেনে যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ না করে পরিকল্পনা অনুসারে স্থাপনা নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল।

কিন্তু এর কোনো সুপারিশই মানেননি কেউ। না সাধারণ মানুষ, না নীতি নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার ওই পরিকল্পনায় প্রধান গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল ২২টি খাল পুনরুদ্ধারে। ওই ২২টি খালের মধ্য থেকে কেবলমাত্র জেলখালটিকে ময়লামুক্ত করতে ২০১৬ সালের ০৩ সেপ্টেম্বর বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করেছিল জেলা প্রশাসন। তৎকালীন জেলা প্রশাসক গাজী সাইফুজ্জামান চারমাস ধরে জেলখালের দুইপাশের স্থাপনা উচ্ছেদ করেন। তারপর কয়েক হাজার মানুষের সহায়তায় খালটি পরিচ্ছন্ন করা হয়েছিল। বর্তমানে আবার পুরোনো চেহারায় ফিরেছে জেলখালটি।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ২০১৬ সালে ২৫৫ জন দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছিল। সেই অবস্থার কিছুটা উন্নত হয়েছে। ওই সময়ে ২৫৫ জন দখলদারকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করা হলেও একেবারে দখলমুক্ত হয়নি খালটি। সর্বশেষ জরিপ বলছে, এ বছরও ওই খালটির তিন কিলোমিটার এলাকা নথুল্লাবাদ থেকে কীর্তনখোলার মুখ পর্যন্ত ৯৫ জন দখলদার স্থাপনা নির্মাণ করে আছেন। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি খাল হত্যায় বরিশাল সিটি করপোরেশনও জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১০ সালে কীর্তনখোলার উৎসমুখের খরস্রোতা ভাটার খালের একাংশ মেরে ফেলে তার ওপর দিয়ে ড্রেন করে দিয়েছে সিটি করপোরেশন।

এভাবে জেলখাল বা ভাটার খাল নয়, নগরীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত লাকুটিয়া খাল, নবগ্রাম খাল, জাগুয়া খাল, আমানতগঞ্জ খাল, টিয়াখালী খাল, নাপিতখালী খাল, ভেদুরিয়া খাল, কাশিপুর খাল, কলাডেমা খাল, কড়াপুর খাল, সাগরদী খাল, চাঁদমারী খাল, নবগ্রাম খাল, শোভারানীর খালসহ ২২টি খালের একটিও কালের পরিক্রমায় স্বাভাবিক গতি নিয়ে বেচে নেই। খালগুলোর মধ্যে দুটি জেলা প্রশাসনের ও দুটি সিটি করপোরেশনের। বাকি ১৮টি খাল বরিশাল জেলা পরিষদের আওতাধীন।

সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানিয়েছেন, খাল পুনরুদ্ধারে বরাদ্দ না থাকায় খালগুলোকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। এ নিয়ে বিশেষ কেউ কথা বলতেও রাজি নন। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, খালগুলোর মালিকানা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকায় তিন দপ্তরের মধ্যেই ঠেলাঠেলি রয়েছে। ফলে খালের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাচ্ছে নগরী থেকে। খালগুলো না থাকায় বৃষ্টি হলেই এখন জলাবদ্ধতায় ডুবে যায় নগরী। জলাবদ্ধতায় সড়কের সংস্কার কাজ টিকছে না বেশিদিন। প্রত্যেক বছর বর্ষা গেলে সুড়কির সড়কে পরিণত হয় প্রধান ও অপ্রধান সড়কগুলো।

বাসদ বরিশাল জেলা কমিটির আহবায়ক প্রকৌশলী ইমরান হাবিব রুমন মনে করেন, নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ না করাটা সঠিক নয়। তবে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের ক্ষেত্রেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। বরিশালের উন্নয়ন পরিকল্পনা মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। দায়িত্ব নিয়ে, সবার মতামতের ভিত্তিতে উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে না বলে উন্নয়নে পিছিয়ে আছে নগরটি।

রুমন আরও বলেন, বরিশাল সিটি করপোরেশন সচারচারই একটি কথা বলে থাকে, বরাদ্দ নেই। এটি মেয়রের ‘অযোগ্যতা’। অন্য সিটি করপোরেশনের মেয়র মন্ত্রনালয়ে গিয়ে বাজেট পাস করিয়ে আনেন। কিন্তু বরিশালের ক্ষেত্রে কোনো বাজেটই তো পাস করাতে পারছেন না। তাহলে নগরীর উন্নয়ন হবে কিভাবে?

আমাদের ফেসবুক পাতা

© All rights reserved © 2018 DailykhoborBarisal24.com

Desing & Developed BY EngineerBD.Net