পরীক্ষার হলে নকলের সুযোগ না দেয়ায় পাবনার সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক মো. মাসুদুর রহমানকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার আরেকটি ঘটনা নাড়া দিয়ে গিয়েছিল পুরো দেশকে। নারায়ণগঞ্জে একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে ভাইরাল হবার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষেরা কান ধরার ছবি আপলোড দিয়ে এক অপূর্ব সুন্দর প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
যে প্রতিবাদের জেরে বাহুবলের অধিকারী অনেক ক্ষমতাবান মানুষজনের অপচেষ্টার পরও ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া যায় নি।বছর তিন ঘুরতে না ঘুরতেই সিসিটিভি ফুটেজ ভাইরাল হয়ে যে দৃশ্য দেশবাসীকে দেখতে হলো তা নিদারুণ মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক ও ভীতিকর। উচ্ছৃঙ্খল কিছু যুবকদের প্রতিটা লাথি-ঘুষি শিক্ষক মাসুদুর রহমানের পিঠে না লেগে, লাগছিল যেন অন্তঃসারশূন্যতায় ভরা অশিক্ষিত এই সমাজের পিঠে। তবে নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় যারা নিজেদের কান ধরা ছবি বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে শিক্ষক শ্যামল কান্তির পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, দাড়ি -টুপিসহ পাগড়ীওয়ালা মাসুদুর রহমানের সময় ‘ফেসবুকীয় জাগ্রত জনতা পার্টির’ তেমন কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাই নি!
এক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অচল ট্রেন্ড কিংবা পোষাকি লেবাস অধবা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ কোনো বিবেচনায় এসেছে কিনা কে জানে? ওহ হো, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের কোনো কথা তো আবার বলা যাবে না! সেটা বলার অধিকার শুধুমাত্র ‘সম্প্রীতির বাংলাদেশ ‘ গড়ার একমাত্র কারিগর পেশাগত দুর্নীতির অভিযোগে দুষ্ট হওয়া পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি পাশে ইসলামি লেবাসধারী লোক বসিয়ে রেখে ফতোয়া দেবে যে হঠাৎ করে দাড়ি রাখা ও টাখনুর উপর কাপড় পরা শুরু করা জঙ্গিবাদের লক্ষণ আর আমরা আশি শতাংশ মুসলমানের দেশের নাগরিক হয়ে সেই বক্তব্যে তালি বাজিয়ে যাব। তালি না বাজালে আবার হয়তো ৫৭ ধারায় কবি হেনরী স্বপনের মতো জেলের ভাত আমাদেরই খেতে হতে পারে।
বরিশালের কবি হেনরি স্বপন শ্রীলংকার গীর্জায় ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার সময়ে স্থানীয় এক খ্রীষ্টান পাদ্রির করা আনন্দ আয়োজনের প্রতিবাদ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছুটা বিপ্লবী স্ট্যাটাস দেন। যার ফলে স্বগোত্রীয় ধর্মান্ধদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেয়ে বসে। কবি মশাই রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা ভিক্ষা করতে গেলো, ওমা উলটো রাষ্ট্রের দাপুটে – দামাল আইনরক্ষা বাহিনি তাকে পুড়ে দিলো চৌদ্দ শিকের কুঠুরিতে! তাও আবার সেই পাদ্রিদের করা ধর্মানুভুতিতে আঘাতের অভিযোগে! ধর্মের অনুভূতি গুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব বোধহয় এইসব পীযুষ আর পাদ্রীদেরই নিলামে তুলে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। শত শত বছর ধরে মহানবীর প্রতি সম্মান জানিয়ে অনুসরণীয় আচার আচরণ কে জঙ্গিবাদের লক্ষণ বানিয়ে তারা ধর্মানুরাগে আঘাত হানে না, আঘাত হানে সারাবিশ্ব যখন শ্রীলংকায় ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনায় শোকাহত তখন গীর্জার মালিক বনে যাওয়া পাদ্রীর অমানবিক আনন্দায়োজনের বিরুদ্ধে গিয়ে একজন সামান্য কবির মানবিক ব্যাক্তিগত মতামত! কি সেলুকাস! তবে পীযুষ বন্দোপাধ্যয় এর জঙ্গি চিহ্নিত করার লক্ষণ আমি হঠাৎ লক্ষ করি ওপার বাংলার জনপ্রিয় অভিনেতা জিতের মধ্যে। সন্দেহজনক ভাবে তিনি হঠাৎ দাড়ি ও টাখনুর ওপর প্যান্ট পড়ে তার সর্বশেষ সিনেমার গানে নাচন কোদন করেছেন সহঅভিনেত্রীর সঙ্গে! জিতের প্রতি নজর দেবার জন্য আমি দ্রুত তার স্বগোত্রীয় ফতোয়াবাজ মোল্লা পীযুষ বন্দোপাধ্যয় এর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। একজন মেধাবী সুঅভিনেতা যদি জঙ্গিবাদে ( বন্দোপাধ্যায় বাবুর দেয়া জঙ্গি নির্ণায়ক ব্যারোমিটার অনুযায়ী) জড়িয়ে যায় তবে সেটা নিতান্ত দুঃখের হবে।
তবে অমানবিক আনন্দ আয়োজনের বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মানুভুতিতে আঘাতের অভিযোগে অভিযুক্ত কবির ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পারফরম্যান্স সত্যিই অবাক করার মতো! বাংলা সিনেমায় দেখা অপরাধ সংগঠিত করে মাস্তানদের পালিয়ে যাবার অনেক পরে উপস্থিত হওয়ার অভ্যাসের অধিকারী এ বাহিনী কবিকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে ব্যাপক দ্রুততার পরিচয় দিয়েছে! যেদেশে খুনি, ধর্ষণকারী, মাদকব্যাবসায়ীরা ওয়ারেন্ট জারি হবার পরও খোলা ঘুড়ে বেড়ায় এবং পুলিশ তাদের খুঁজেই পায় না সেদেশে সাধারণ এক কবিকে মাজায় দড়ি পড়ানোর যে অতিতৎপরতা তারা দেখিয়েছে তা সত্যি অনুপ্রাণীত করার মতো মনোমুগ্ধকর খবর।
আরেকটা মনোমুগ্ধকর খবর হচ্ছে এ দেশে বলিশ বয়ে নেবার জন্য লেবারদের প্রায় আটশ টাকা করে দেওয়া হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তাও আবার প্রতিটা বালিশের জন্য! এমন চলতে থাকলে ওখানে বালিশ বয়ে বেড়ানো নিম্নবর্গের মানুষেরা অতিদ্রুত যে অর্থনৈতিক ভাবে উচ্চবর্গের অধিবাসী হবে সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আর সেই বালিশের দাম দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! সেখানে ৩৩০টি তোশক কিনতে খরচ হিসেবে দেখানো হয়েছে ১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ইশশ একবার যদি সেই তোশকে ওই বালিশে ঘুমাতে পারতাম! বাংলাদেশে রমজান মাস এলেই সবকিছুকে অদ্ভুতভাবে পবিত্র করণ করা হয়। পবিত্র রমজান মাস, পবিত্র দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, পবিত্র সড়ক দূর্ঘটনা, পবিত্র লোডশেডিং ইত্যাদি পবিত্র বিষয়ের মধ্যে এই কদিনে দেখা এসব পবিত্র দূর্নীতি, পবিত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধ, পবিত্র শিক্ষক লাঞ্ছনা একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে আর সবার মতোই আমাকে কষ্ট দেয়। এই মরুদন্ডহীন, ঘুণেধরা, অসভ্য সমাজ ব্যাবস্থা কোনো সুনাগরিকের কাছেই কাম্য না।
যদি মোটা দাগে বলা যায় তবে বলতে হয় এসব অনৈতিক অনিয়মতান্ত্রিক অবিবেচক অশোভন কার্যক্রম পুরো জাতিকে গ্রাস করেছে অনৈতিক অশিক্ষার দরুন। নূন্যতম নৈতিকতা যদি আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অর্জন করতাম তবে শিক্ষককে পেটানোর মতো গর্হিত – লজ্জিত কর্মকান্ড আমাদের দেখতে হতো না।আজ দেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসলে শিক্ষাদান হচ্ছে আমার ঠিক জানা নেই।শিক্ষাব্যবস্থার নামে আমরা যেটা দেখছি সেটা হচ্ছে পরীক্ষা ব্যাবস্থা।জাপানে নাকি প্রাথমিক শিক্ষার পুরোটা জুরেই থাকে নৈতিক শিক্ষা তাও আবার কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়া। তাই হয়তো জাপানি লোকেরা এই দুর্নীতির মহারাজ্যে এসেও নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে সেতু নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করে কয়েকশত কোটি টাকা আমাদের সরকারকে ফেরত দেবার উদাহরণ সৃষ্টি করে। আমরা চমকিত হয়ে খবরের শিরোনাম করি ঘটনাটাকে যেখানে তাদের কাছে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কাজ আগে শেষ হয়ে গেলে কিছু টাকা বাঁচবে আব সেটা সংশ্লিষ্ট দফতরে ফেরত দিতে হবে এমন সাধারণ জিনিসটা যখন আমাদের পঁচে যাওয়া সমাজ অস্বাভাবিক ভাবে দেখে তখন আসলেই নূন্যতম নৈতিকতা শিক্ষার ব্যাপারে আমরা কতটা অনাগ্রহী তা দেখতে চশমায় আলাদা কোনো পাওয়ার লাগে না।
লেখক : শফিক মুন্সি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
Desing & Developed BY EngineerBD.Net
Leave a Reply