রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোর অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট রোধে সৎ, যোগ্য, মেধাবী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে একটি কমিটি গঠন করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা। অবশেষে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি সংক্ষেপে বিএসসি গঠন করায় তাদের দাবি পূরণ হয়। বিএসসি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা নিয়োগে স্বজনপ্রীতি কিংবা ঘুষের মাধ্যমে চাকরি পাবার সংস্কৃতি দূর করতে পারলেও কিছু গুরুতর অব্যাবস্থাপনা বিশেষ করে নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে ঘটা অনিয়মগুলোর খুব একটা সুরাহা করতে পারছে না যা সত্যি হতাশাজনক।
আর এই হতাশা চরমভাবে প্রকাশ পেয়েছে গতবছর জানুয়ারিতে হাজার হাজার চাকরি প্রার্থীদের এই সিলেকশন কমিটির বিরুদ্ধে রাজধানীতে করা আন্দোলনের মাধ্যমে। অব্যাবস্থাপনা পূর্ণ চাকরির পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যেটা চলে আসে সেটা হচ্ছে প্রশ্নের মান।এই বিএসসি কর্তৃক গৃহীত গেল কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে মৌলিক প্রশ্ন করার বদলে প্রশ্নকর্তারা বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে হুবহু কপি করে প্রশ্ন করাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে! এই কপিকৃত প্রশ্ন পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করা চক্রটির জন্য বিশেষ সুবিধা এনে দেয় কারণ তারা খুব দ্রুত ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্ন বাইরে পাঠিয়ে উত্তর জেনে নিতে পারে। বাইরে অবস্থান করা এই চক্রের সদস্যরা প্রশ্নটি গুগলে সার্চ দেবার মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডে উত্তর বের করে ফেলে।
এই বিষয়টি বেশি প্রভাব ফেলে পরীক্ষার্থীদের গণিত অংশে। কপি না করে অন্তত গণিত অংশে মৌলিক প্রশ্ন করলে দেখা যাবে অসদুপায় অবলম্বনকারীদেরকেও আর সবার মতো মাথা খাটিয়ে উত্তর বের করতে হচ্ছে যা একটি স্বচ্ছ নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করার অন্যতম স্তম্ভ। দ্বিতীয়ত, পরীক্ষা কেন্দ্রের ব্যাপারে সবার যুক্তিযুক্ত আপত্তি লক্ষ করা যায় বিশেষ করে ঢাকার বাইরের চাকরিপ্রার্থীদের। বিএসসির প্রতিটা নিয়োগ পরীক্ষায় সারা বাংলাদেশের কয়েকলাখ পরীক্ষার্থী আবেদন করে কিন্তু সবাইকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ঢাকায় যেতে হয় যা সময় এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে প্রতিটি পরীক্ষার্থীকে। আবার কিছু কিছু পরীক্ষা কেন্দ্রে দেখা যায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতির কারণে স্থানীয় অপরাজনীতি চর্চাকারী ব্যাক্তিরা পেশি শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে কিছু পরীক্ষার্থীকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের চেষ্টা করে এবং পরীক্ষাকে প্রভাবিত করে, যা সম্পূর্ণ আইন ও নৈতিকতা বিরোধী অপকর্ম।এই অপরাজনৈতিক ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রশ্নফাঁসকারী চক্র। তাদের দ্বৈত সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সিলেকশন কমিটি কর্তৃক গৃহীত পরীক্ষা গুলো হাস্যকরভাবে নিন্দিত হচ্ছে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ যুবকদের কাছে। বেকার যুবকের সঙ্গে এ এক অমানবিক প্রহসন যার দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারে না রাষ্ট্রের সরকারযন্ত্র। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী যুবকদের কাছ থেকে কোনো ফি না নেবার সিদ্ধান্তটি অতিতে সিলেকশন কমিটির বাহবার কারণ হলেও এখন ব্যাপারটি নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। বিনামূল্যে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে একটি অসৎ প্রহসনের অংশ না হয়ে কিছু ফি প্রদানের মাধ্যমে অন্তত নিজ বিভাগে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকরী উপস্থিতিতে পরীক্ষা প্রদানকেই সবাই বিনাবাক্যে মেনে নেবেই বলে আমার বিশ্বাস।
এই নামমাত্র ফি গ্রহণ করে যদি বিএসসি মৌলিক প্রশ্নে, স্বচ্ছ প্রতিযোগীতাপূর্ণ ব্যাবস্থায়, স্থানীয় পেশি শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে, পর্যাপ্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো অন্তত সকল বিভাগীয় শহরে নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে তবে বিএসসি লাখো বেকারের ভালোবাসায় সিক্ত হবে এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলো সৎ ও কর্মঠ কর্মকর্তা পাবে।
আরেকটা বিশেষ দিক আলোচনা না করলেই নয়। সেটা হচ্ছে বর্তমান বিশ্ব টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে প্রতিটি দেশের পিঁছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেমন প্রতিবন্ধী কিংবা উপজাতিদের কর্মে প্রবেশে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করছে। বর্তমান সরকার যেখানে এ জনগোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে আন্তরিক সেখানে শিক্ষিত বেকার প্রতিবন্ধী মানুষ এবং উপজাতিদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করা সিলেকশন কমিটির কার্যক্রম এবং এর সামাজিক প্রভাবকে প্রশংসিত করবে অবিসংবাদিত ভাবে।
লেখক : শফিক মুন্সি, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র আন্দোলন কর্মী।
Desing & Developed BY EngineerBD.Net
Leave a Reply